নির্মাতার কথা: আজকের অতিথি মাবরুর রশীদ বান্নাহ

মার্জান সোহাগী:: বর্তমান জীবনে বিনোদনের জন্য আমরা সবাই কেবলই গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। কারণ ব্যস্ত জীবনে অন্যকিছু প্রায় অসম্ভব। একটু সময় পেলেই আমরা হয়তো একটি ভালো নাটক বা ভালো সিনেমা দেখে মানসিক ক্লান্তি বা একঘেয়েমি দূর করি। আর আমাদের বিনোদিত করার লক্ষে মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপক আয়োজন নিয়ে প্রত্যহ কাজ করেই যাচ্ছে।
অভিনেতা-অভিনেত্রী, নির্মাতা এবং আনুসঙ্গিক অনেকগুলো মানুষের পূর্ণ শ্রম, নিবেদন এবং মেধার সঠিক মিশ্রণেই একটি ভালো প্রডাকশন সম্ভব হয়। পুরো বিষয়টির মধ্যে আমরা কেবল অভিনেতা-অভিনেত্রীর শ্রমটুকুই দেখতে পাই এবং সেটাই প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু তাদেরকে এই চরিত্রগুলো দেওয়ার পেছনে রয়েছে প্রধান দুটি ধাপ। প্রথমটি কল্পনার আর দ্বিতীয়টি আঁকার। অর্থাৎ সবার প্রথমে স্ক্রিপ্ট এবং সেটা থেকেই নির্মাণ। স্ক্রীপ্ট হাতে নিয়েই একজন নির্মাতা পুরোটা প্রডাকশন, নাটক হোক বা সিনেমা তার প্রতিটি দৃশ্য দেখতে শুরু করেন।
কল্পনায় তিনি দেখেন স্থান, সময়, এমনকি প্রতিটি দৃশ্যেই আনুষঙ্গিক কি কি উপাদান রয়েছে। বুঝে নেন সংলাপের অর্থ এবং গভীরতা। গল্পের মেজাজ, সূর এবং সেই মর্মেই কাস্টিং এবং স্যুটিং। সর্বপরি হাজারো বিষয়ের সঠিক অংক কষা এবং প্রয়োগ। শুধু নিজে বুঝলেই চলবে না, সবাইকে তা বোঝানো এবং রুপ দেওয়া।
পুরো বিষয়টাকে আমরা দর্শক কীভাবে মূল্যায়ন করি? আমরা কয়জনই বা একটি নাটক বা সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে আগে খুঁজি নির্মাতা কে? বা ভালো লাগলে দেখে আসি নির্মাণ করেছেন কে? হয়তো সংখ্যায় তারা খুব বেশি নয়। সাধারণ দর্শকের কথা না হয় পরেই বলি, আমরা গণমাধ্যমই বা নির্মাতাকে নিয়ে কতটুকু ব্যস্ত?
আমরা কেবল ক্যামেরার সামনেটা নিয়েই চিন্তা করি। তবে সে বিষয়ে নির্মাতাদের খুব একটা ভ্রুক্ষেপ রয়েছে বলে মনে হয় না। তেমন হলে এতো সংখ্যক নির্মাণ আমরা পেতাম না। সুতরাং সৃষ্টির আনন্দই তাঁদের কাছে মূখ্য। একেকটি ভালো নির্মাণই তাঁদের প্রশান্তি। তবে তাঁদেরকি কোন কথা নেই? অবশ্যই রয়েছে।
যাদের পুরো নিবেদনেই আমাদের সামনে আসে এমন সকল নাটক, সিনেমা যার মধ্যে আমরা নিজেদের প্রাত্যহিক জীবন, আবেগ, সুখ এবং দুঃখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই, এমন মানুষদের কাছে আসলে আমাদের অনেক কিছু জানার আছে।
তাঁদের অভিজ্ঞতা, চিন্তা এবং দৃষ্টিকোন, সর্বপরি আমাদের চাহিদা বুঝতে পারার ক্ষমতা নিয়েই আসলে জিজ্ঞাসা রয়েছে অনেক কিছুই। আর তাই ‘নির্মাতার কথা’ পর্বে আজকের অতিথি তরুণ নির্মাতা- মাবরুর রশীদ বান্নাহ। দৈনিক যুগান্তরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন তাঁর মনের কথা।
এমটিভি নিউজ২৪: কেমন আছেন?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: ঘটে যাওয়া চকবাজারের অগ্নকান্ডে মানসিকভাবে অনেকটাই বিষন্ন। তবুও সময়ের দাবিতে চলছে সবই।
এমটিভি নিউজ২৪: নাটক নির্মাণ বা নির্দেশনায় ক্যারিয়ার তৈরি করার মূল অনুপ্রেরণা কীভাবে পেলেন?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: আসলে ক্যারিয়ারের চিন্তার তুলনায় ভালোবাসার জায়গাটাই প্রথমে এসেছে। কারণ, এই ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গঠন করতে পুরো সময়টাই যুদ্ধের। তবে শৈল্পিক চিন্তা এবং ভালোলাগাই পুঁজি এবং অনুপ্রেরণা। বা বলতে পারেন মনের চাহিদা।
এমটিভি নিউজ২৪: এবার সরাসরি চলে আসি নির্মাণের প্রসঙ্গে। নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন ধরনের গল্পকে প্রাধান্য দেন?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: আসলে এই বিষয়গুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়। এখনো পর্যন্ত জীবন ঘনিষ্ট গল্পগুলোকেই নাটকে রুপ দিতে চেয়েছি। প্রতিটি মানুষের জীবনেই হাজারো নাটক এবং সিনেমা প্রতিনিয়ত ঘটে যায়। প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার মধ্যে কোন একটি উপাদান আমি গ্রহণ করেছি এবং সেটাকে আবর্তণ করেই আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো কল্পনা করে বাস্তবে আঁকতে চেষ্টা করেছি। যা দর্শক সহজেই নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারে। প্রতিটি নাটক দেখেই যেন দর্শক নিজেকে ওই অবস্থানে বসাতে পারে, সুখ এবং দুঃখগুলোকে যেন নিজের জায়গা থেকেই উপলব্ধি করতে পারে এটাই চেয়েছি সবসময়। তবে ভবিষ্যতে আমার আগ্রহের জায়গায় হয়তো পরিবর্তন আসতেই পারে। যেমন আমি সম্পূর্ণ কল্পনা নির্ভর নাটক বানানো শুরু করতেই পারি। তাই এই বিষয়টি নির্দিষ্ট নয়।
এমটিভি নিউজ২৪: আপনার মতে ভালো গল্প বা স্ক্রীপ্ট এবং নির্মাণের সঠিক সামঞ্জস্য জরুরী নাকি নির্মাণের মাধ্যমেই স্ক্রীপ্টের মানকে উপেক্ষা করা সম্ভব?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: অবশ্যই গল্পের ভালো ক্ষেত্র, গল্প এবং স্ক্রীপ্টের সঙ্গে নির্মাণের ভীষন সম্পর্ক। স্ক্রীপ্টে ঘাটতি থাকলেও নাটক নির্মাণ করা যায় তবে সেখানে গলদ থেকেই যায়। হয়তো দর্শক বুঝতে পারে না। তবে মানের ঘাটতি যেটা থেকে যায় তা নির্মাতাকে নির্মাণের প্রশান্তিটা দেয় না। তাই দুটোই জরুরী।
এমটিভি নিউজ২৪: স্যুটিংয়ের ক্ষেত্রে ‘ইমপ্রোভাইজিং’ যে টার্মটি রয়েছে অর্থাৎ স্পটেই কাহিনী বা দৃশ্যের চাহিদানুযায়ী সংলাপ তৈরি করে স্যুটিং করা। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: ইমপ্রোভাইজিং আমি আসলেই পছন্দ করি এবং আমি এটা করেও থাকি। তবে বিষয়টা পুরোপুরি ঝুঁকিহীন নয়। কারণ, ইমপ্রোভাইজড সংলাপগুলো যেন অপ্রাসঙ্গিক বা এলোমেলো না হয়, শব্দ ব্যবহারে যেন সমস্যা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। আর এক্ষেত্রে অভিনয়শিল্পীকেও চৌকষ হতে হয়। তার সংলাপ প্রদানে যেন জড়তা না থাকে সেটা খুব জরুরী। তবে সবটা মিলে গেলে ইমপ্রোভাইজিড দৃশ্যগুলো বেশ সাবলিল এবং বাস্তব হয়ে ওঠে। অভিনয় বলে মনে হয় না।
এমটিভি নিউজ২৪: নির্মাণের ক্ষেত্রে সুন্দর শব্দ চয়ন বা ভাষাশৈলী কতটা জরুরী?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: অবশ্যই জরুরী। তবে সুন্দর শব্দ বা ভাষাশৈলী বলতে আমি কেবল বইয়ের ভাষাই বোঝাচ্ছি না। বিষয়টি কিন্তু আপেক্ষিক অনেকটা। অর্থাৎ চরিত্রের চাহিদানুযায়ী শব্দ চয়ন এবং ভাষা নির্ধারণই নির্মাণের শৈলী হওয়া উচিত। কারণ সব চরিত্র যদি শুদ্ধ কথা বলে তাহলে সবকিছুই অবাস্তব হবে। তাই যার যে চরিত্র সে সেভাবেই কথা বলবে; তাহলেই সাবলিল লাগবে। কিন্তু কোন অসামাজিক শব্দ বা বাংলা শব্দ ভান্ডারকে বিকৃত করে এমন শব্দ ব্যবহার করি না।
এমটিভি নিউজ২৪: সমাজের ওপর নাটকের বিষয়বস্তুর প্রভাব কতটা?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: ব্যাপক প্রভাব। আর তাই আমাদের অনেক দায়িত্বশীল হতে হয়। যেমন- কোন ইতিবাচক চরিত্রে যদি আমরা অনৈতিক কোন কার্যকলাপ দেখাই তাহলে তা দর্শকের চরিত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। বা তরুণ কোন চরিত্রকে যদি আমরা বেয়াড়াভাবে দেখিয়ে সেটাকে ইতিবাচক রুপ দেই তবে তা তরুণ সমাজ গ্রহণ করবে। সুতরাং এ বিষয়ে আমি খুবই সজাগ।
এমটিভি নিউজ২৪: স্যুটিংয়ের ক্ষেত্রে রিহার্সালের গুরুত্ব কতটা?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: নিঃসন্দেহে রিহার্সাল জরুরী। তা না হলে শিল্পী সংলাপের মেজাজ এবং চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আমি প্রতিটি টেক-এর আগেই রিহার্সাল করিয়ে নেই।
এমটিভি নিউজ২৪: মাসে কমপক্ষে কয়টি নাটক স্যুট করেন?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: দুটো বা তিনটা স্যুট করা হয়। তবে ঈদের সময় বিষয়টা অন্যরকম হয়। মাসে ১০ থেকে ২০টিও স্যুট করা হয়েছে।
এমটিভি নিউজ২৪: সেক্ষেত্রে প্রতিটি নাটকের মানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দিতে পারেন কি?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: না, আমি এটা কখনোই বলবো না যে আমি আমার সব কাজ নিয়েই খুশি। কোন কোন কাজ এমন হয় যা আমাকে প্রশান্তি দেয় না। তবে তার জন্য সময় যেমন দায়ী তেমন বাজেটও ভীষন গুরুত্বপূর্ণ।
এমটিভি নিউজ২৪: বাজেটের কথা বলছিলেন। আসলে প্রয়োজনীয় বাজেট সহায়তা কি সচরাচর পাওয়া যায়?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: না। বাংলাদেশে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং এজন্যই এখনো সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো খুবই কম বাজেট দেয় বা প্রডাকশনগুলো এখন অনেকটাই কেবল ব্যবসার উপাদান। যত আর্থিক লাভ সম্ভব। অথচ আসলে লাভের ক্ষেত্র যেটা হওয়া উচিত তা হলো সুন্দর একটি নির্মাণ। সেদিকে চ্যানেলগুলোর নজর তুলনামূলক কমই বলবো। ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এবং নিজের টাকা যোগ করে নাটক বানিয়েছি। প্রতি নতুন নির্মাতার ক্ষেত্রে এটা বড় চ্যালেঞ্জ।
এমটিভি নিউজ২৪: এই বাজেট চ্যালেঞ্জের জন্য কি অনেকে ঝরে পড়ছে বলে মনে করেন?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: অবশ্যই। এটাই সত্য। অনেক তরুণ মেধাবী হয়তো নিরুৎসাহিত হয়ে ঝরে পড়ছে। আমার জায়গা থেকে আমি নতুনদের ভালো কাজ দেখতে পছন্দ করি এবং চাই মেধাবীরা আরও আসুক, ইন্ডাস্ট্রিকে আরও সমৃদ্ধ করুক। তবে জানি না এই বাজেট সংকটের কারণে কয়জন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।
এমটিভি নিউজ২৪: একজন নির্মাতা হিসেবে কোন জায়গাটি ছাপিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন?
মাবরুর রশীদ বান্নাহ: গতকালকের আমিকে আজকের আমি হারাতে চাই। অর্থাৎ প্রতিদিনই নিজের কাজকে হারিয়ে তুলনামূলক ভালো কাজ করতে চেষ্টা করি। সবার মন্তব্যকে গুরুত্ব দেই। তবে প্রশংসায় ভাসিনা। কারণ, নিরবে নিজেকে নিজেই বিচার করি। উৎসাহ সাদরে গ্রহণ করি।